মোগল শাহজাদীদের স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা - Slogaan BD

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

মোগল শাহজাদীদের স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা

১৬৫৪ সালের বসন্তের এক দিন। শাহজাহানাবাদের চাঁদনী চকের স্বাভাবিক কোলাহল হঠাৎই ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল। রাস্তা ধরে এগিয়ে আসতে লাগল এক জমকালো শোভাযাত্রা। হালকা চালে এগিয়ে চলা হাতির সামনে পানি ছিটাতে ছিটাতে এগিয়ে আসছিল কয়েকজন। পানি ছিটানোর উদ্দেশ্য রাস্তায় যেন ধুলা না ওড়ে। শোভাযাত্রায় ছিল অশ্বারোহী ও পদাতিক সেনাদের দল। ঘোড়াগুলো দ্রুতগামী আর সেনারা দুর্ধর্ষ ও ভাবলেশহীন। সেনাদের পেছনে রাজকীয় হাতি আর সেই হাতিকে ঘিরে আছে একদল খোজা। এরা হাতে সোনালি লাঠি নিয়ে আশপাশের মানুষকে খেদিয়ে বেড়াচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরপর হাঁক ছাড়ছে ‘হুঁশিয়ার!’ এক্ষেত্রে আবিসিনিয়ার খোজারা ভয়ানক, এদের কৃষ্ণবর্ণের শরীর পেশিবহুল। সাধারণ মানুষকে এরা বিন্দুমাত্র সম্মান দেখাত না। দোকানিরা পিছিয়ে গিয়ে সম্ভ্রমে রাস্তা ছেড়ে দিল। এই শোভাযাত্রা যতক্ষণ পার না হয়, ততক্ষণ তারা কেনাবেচা, দরদাম করা ভুলে যেত। বাজারের পাশে দোকানে পারস্য থেকে আমদানি করা কফির মগে চুমুক দিতে থাকা ধনী, অভিজাত দাঁড়িয়ে গেল শোভাযাত্রা দেখতে। হাতির চারপাশে একদল চাকর সুগন্ধি বিলাচ্ছে, যেন কোনো কটু গন্ধ যাত্রীর নাকে না আসে। একজন নারী চাকর হাতে ধূপধুনোর কৌটা নিয়ে হাতির সামনে সামনে এগোতে এগোতে প্রতি পদক্ষেপে চিত্কার করছিল: ‘বিসমিল্লাহ! শাহজাদী জাহানারা বেগম যাচ্ছেন! বিসমিল্লাহ!’


জাহানারা ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের বড় কন্যা। জাহানারার বয়স তখন ৪০ এবং তিনি অবিবাহিত। তিনি মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী, তিনিই বাদশাহ বেগম। এক কথায় তিনি বেগম সাহেবা।

সম্রাট শাহজাহান শাহজাহানাবাদের কাজ শেষ করেন ১৬৪৮ সালে। এ শহরের অনেক কিছুই হয়েছিল জাহানারার পরিকল্পনা অনুসারে। নগরের ১৯টি রাজকীয় ভবনের পাঁচটি হয়েছিল তার হাতে। সুরাট বন্দর ও ভূভাগের রাজস্ব ছিল জাহানারার অধীন, যার মূল্য ১৪ লাখ রুপি। পানিপথের জায়গিরও ছিল জাহানারার, সেখানে থেকে তিনি রাজস্ব পেতেন ২ লাখ রুপি। জাহানারার সাহিবি নামে একটি বাণিজ্য জাহাজ ছিল, যেটি সুরাট বন্দর থেকে যাত্রা করে ওলন্দাজ ও ইংরেজদের সঙ্গে বেশ লাভজনক ব্যবসা করত। এসবের সঙ্গে রাজকীয় অর্থ বরাদ্দ মিলিয়ে তার বার্ষিক আয় ছিল ৩০ লাখ রুপি (আজকের বাজারদরে এর পরিমাণ ১৫০ কোটি রুপি)। এছাড়া বাণিজ্যে তার আশীর্বাদ পেতে দরবারের অনেক অভিজাত ও বিদেশী বণিক জাহানারাকে মূল্যবান রত্নপাথর ও অলংকার উপহার দিতেন।

মোগল বংশের নারীদের অনেকেই শুধু শিক্ষিত ছিলেন তা-ই নয়, সেই সঙ্গে তারা এমন কিছু লেখনী রেখে গেছেন, যা শুধু সাহিত্যমানে নয়, বরং ঐতিহাসিকভাবেও মূল্যবান। জাহানারা ছিলেন সুফিবাদ নিয়ে প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী। জাহানারা কবিতা লিখেছেন এবং বিখ্যাত সুফি সন্ত খাজা মঈন-উদ-দীন চিশতীর জীবনী লিখেছিলেন, যা মুনিস-উল-আরওয়াহ নামে পরিচিত। বলা হয়, জাহানারা ছিলেন মোগল বংশীয় নারীদের মধ্যে সবচেয়ে সংস্কৃতিমনা, জ্ঞানী ও ঋদ্ধ রুচির নারী। মানুচ্চি জানিয়েছেন, জাহানারাকে সবাই ভালোবাসতেন। জাহানারা ছিলেন পিতা শাহজাহানের প্রিয় কন্যা। আমরা জানি, শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারার মতো জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহজাদা দারা শুকো ছিলেন সংস্কৃতিমনা, জ্ঞানসাধক। এ বৈশিষ্ট্যগুলো পিতা ও তার দুই জ্যেষ্ঠ পুত্র-কন্যাকে সম্পর্কের এক ত্রিভুজে আবদ্ধ করেছিল। জাহানারা ও দারা শুকো ছিলেন শাহজাহানের প্রিয় পুত্র-কন্যা। অন্যদিকে দারা ছিলেন মোগল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে শাহজাহানের কনিষ্ঠ কন্যা রোশনারা ও পুত্র আওরঙ্গজেব অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং পরবর্তীকালে সিংহাসন নিয়ে চলা ভাইদের যুদ্ধে এ সম্পর্কগুলোর দলাদলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।&dquote;&dquote;

সে গল্পে যাওয়ার আগে জাহানারার জীবনের গল্প প্রথম থেকে শুরু করা যাক। তার পিতা শাহজাহান দিল্লির সিংহাসনে বসেছিলেন ৩৬ বছর বয়সে। জাহানারার বয়স তখন ১৪। সিংহাসনে বসেই শাহজাহান সর্বোচ্চ জোর দিয়েছিলেন নূরজাহানের সব স্মৃতি, প্রভাবকে মুছে ফেলতে। কারণ পিতা জাহাঙ্গীর নূরজাহানের প্রভাবেই একসময় তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন, শাহজাহানের এমনটাই ধারণা ছিল। সিংহাসনে বসে তিনি স্ত্রী আরজুমান্দ বানুকে সাম্রাজ্যের বাদশাহ বেগম বলে ঘোষণা করেন এবং তাকে মুমতাজ মহল উপাধিতে ভূষিত করেন। সাম্রাজ্যে মুমতাজ মহলের পরই স্থান হয় বেগম সাহেবার। জাহানারার জন্য বার্ষিক বরাদ্দ নির্দিষ্ট করা হয় ৬ লাখ রুপি, যেখানে শাহজাহানের বাকি ছয় সন্তানের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৬ লাখ রুপি। দুই বছরের মধ্যে জাহানারাকে দুটি বাণিজ্য জাহাজও দেয়া হয়—সাহি ও গাঞ্জাবার। তিন বছরের মাথায় মারা যান মুমতাজ মহল। তার মৃত্যু হয়েছিল সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। সেই জটিল ও অন্তিম সময়ে মুমতাজ মহলের পাশে ছিলেন ১৭ বছরের জাহানারা। মায়ের জীবন রক্ষার জন্য অকাতরে গরিবদের মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা আর ধনরত্ন দান করেছেন—মায়ের জন্য একটি অলৌকিক করুণার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু মুমতাজ মহল বাঁচেননি। মায়ের জন্য শোক করার জন্য খুব বেশি সময়-সুযোগ জাহানারা পাননি। তাকে ব্যস্ত হয়ে যেতে হয়েছে প্রাসাদ ও শোকাতুর পিতাকে সামলাতে। তার অন্য স্ত্রীদের উপেক্ষা করে শাহজাহান জাহানারাকে বাদশাহ বেগম হিসেবে ঘোষণা করেন। জাহানারার বার্ষিক বরাদ্দ এবার উন্নীত হয় ১০ লাখ রুপিতে। প্রাসাদ সামলাতে ব্যস্ত অসংখ্য কর্মকর্তা ও চাকরবাকর এবার সরাসরি জাহানারার অধীনে চলে এলেন। এবার রাজকীয় সিলমোহরের দায়িত্ব পেলেন জাহানারা। মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এত অল্প বয়সী, অবিবাহিতা কোনো নারী এ দায়িত্ব ও সম্মান পেলেন। জ্যেষ্ঠ কন্যার প্রতিভা ও আনুগত্যের প্রতি শাহজাহানের গভীর বিশ্বাস এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শাহজাহান মুমতাজ মহলের সম্পদের অর্ধেকও দিয়ে দিলেন জাহানারাকে; সোনা-রুপা, হীরা-জহরত মিলিয়ে এর পরিমাণ ছিল ১ কোটি রুপি। বাকি অর্ধেক মামতাজ মহলের বাকি ছয় সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এই ১ কোটি রুপির অর্থমূল্যটা বুঝতে হলে এটা স্মরণে রাখা যেতে পারে যে তখন তাজমহল নির্মাণে মোট খরচ হয়েছিল ৫০ লাখ রুপি। জীবনের বাকি ২৭ বছর জাহানারা বেগম বাদশাহ বেগম ও মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারী হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন।&dquote;&dquote;

মুমতাজ মহলের মৃত্যুর পরবর্তী ১০ বছর জাহানারার জীবন কেটেছে প্রাসাদ সামলাতে সামলাতে। ছোট ভাই মুরাদ বকশের বয়স তখন সাত বছর, তার দেখভাল, শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্ব ছিল জাহানারার কাঁধে। এসবের পাশাপাশি রাজকীয় নানা উৎসবের আয়োজনও করতে হয়েছে জাহানারাকে। এর মধ্যে প্রথম ও সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ছিল তার প্রিয় ভ্রাতা শাহজাদা দারা শুকোর বিয়ের উৎসব। ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে আগ্রায় এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দারা ছিলেন জাহানারার এক বছরের ছোট। এ দুই ভাইবোনের মধ্যে ছিল গভীর বোঝাপড়া। দারা শুকোর বিয়ে ছিল মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সবচেয়ে জাঁকজমক ও ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান। এ আয়োজনে ৩২ লাখ রুপি খরচ হয়েছিল। একজন ইংরেজ পর্যটক পিটার মান্ডির বিবরণী থেকে এ বিয়ের জৌলুস সম্পর্কে জানা যায়।

দারার পর আরো দুই ভাই শাহ সুজা ও মুরাদ বকশের বিয়েও আয়োজন করেন জাহানারা। যত দিন যাচ্ছিল, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, জাহানারা যেমন শাহজাহানের প্রিয় কন্যা, তেমনি পুত্রদের মধ্যে দারা শুকো। ফলে মোগল সাম্রাজ্যের ক্ষমতা এ দুই ভাইবোনের হাতেই যাচ্ছে, সেটা নিয়ে বাজারে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাহানারা ও দারার এ ক্ষমতা ও জৌলুসের পেছনেই নীরবে প্রস্তুত হচ্ছিলেন তাদের এক ছোট ভাই আওরঙ্গজেব। শাহজাহানের পুত্র-কন্যাদের মধ্যে আওরঙ্গজেব ছিলেন অন্যদের তুলনায় একটু ভিন্ন চরিত্রের। তার মুখে হাসি কম, মগজে রাজনীতি বেশি খেলত। গোপনে কাজ সারতেন এবং অব্যর্থভাবে। হাতির সঙ্গে লড়াইয়ে সাহসিকতা দেখিয়ে পিতার কাছ থেকে তারুণ্যেই বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন। ১৬৩৭ সালে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে বিয়ে হয় পারস্যের শাহ তাহমাসপের বংশধর দিলরাস বানু বেগমের সঙ্গে। এ বিয়ের আয়োজনও করেছিলেন জাহানারা। দরবারি সব আনুষ্ঠানিকতাই যথাযথভাবে পালিত হয়েছিল। শাহজাহান নিজে পুত্রকে মুক্তার সেহরা পরিয়ে দেন।

এবার যেন জাহানারা একটু হাঁফিয়ে উঠলেন। পুরো প্রাসাদ আর পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে তিনি যেন ক্লান্ত। ‘আমার বয়স এখন ২৭। আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না।’ জাহানারা এবার জীবনের দার্শনিক খোঁজ শুরু করেন আর এ লক্ষ্যে সুফিবাদই ছিল তার আরাধ্য গন্তব্য।

সুফিবাদের সঙ্গে জাহানারার পরিচয় হয়েছিল ভাই দারা শুকোর হাত ধরে। দারা শুকো ছিলেন শেখ মিয়া মীরের শিষ্য। মিয়ার মৃত্যুর পর দারা মুল্লা শাহ বাদাখশির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দারা ছিলেন কাদিরিয়া তরিকার অনুসারী। এক গ্রীষ্মে কাশ্মীরে অবস্থানকালে দারা জাহানারাকে মুল্লা শাহের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।&dquote;&dquote;

শাহজাহান সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন রাজধানী শহর নির্মাণের। এটাই হলো শাহজাহানাবাদ—মোগল সাম্রাজ্যের শেষ বড় শহর। শাহজাহানের পরিবার, চাকর, কর্মকর্তা, কেরানি মিলিয়ে মোট মানুষ ছিল সাত হাজার। এর সঙ্গে রাজপরিবারের সেনা, চাকর ও তাদের পরিবার মিলিয়ে মোট জনসংখ্যা হয় ৫৭ হাজার। এর সঙ্গে ছিলেন ৭০ বা তার বেশি আমির ও তাদের পরিবার। এই বিপুল মানুষের জন্য বড়সড় আকারের নগরই প্রয়োজন ছিল।

যমুনা নদীর ডান পারে খালি জায়গায় গড়ে ওঠে শাহজাহানাবাদ। কয়েক মাইল দূরে যমুনার উজান থেকে খাল কেটে প্রাসাদ ও শহরে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

শাহজাহানাবাদে জাহানারা বেগম তার মহলকে নিজস্ব রুচি অনুসারে রঙ করিয়েছিলেন, দেয়ালে বসিয়েছিলেন কাচের টুকরো। তার মহলের ব্যালকনির ঝাঁজরি দিয়ে তিনি যমুনা নদী দেখতে পেতেন।

যেকোনো শহরের মতো শাহজাহানাবাদেরও প্রয়োজন ছিল বাজারের। শাহজাহানাবাদের দুটো নতুন বাজার নির্মাণের কাজ শুরু হলো এবং দুটো কাজই হচ্ছিল দুজন নারীর তত্ত্বাবধানে। একটি নির্মাণ করছিলেন শাহজাহানের স্ত্রী আকবরবাদী বেগম—ফৈজ বাজার। অন্যদিকে জাহানারা নির্মাণ করছিলেন শাহজাহানাবাদের কেন্দ্রীয় বাজার—চাঁদনী চক। দৈর্ঘ্যে ১ হাজার ৫২০ গজ এবং এতে দোকান ছিল ১ হাজার ৫৬০টি। বাজারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যেত একটি বড় খাল। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত, এমনকি বিদেশ থেকেও বিক্রেতারা তাদের পণ্য বিক্রি করতে এই বাজারে আসত। চাঁদনী চকে তখন তুরস্ক, জাঞ্জিবার, সিরিয়া, ইয়েমেন, আরব, ইরাক, খুরাসান, চীন, তিব্বতের পাশাপাশি ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড থেকে বণিকরা আসত। জাহানারা চাঁদনী চকের পাশাপাশি শাহজাহানাবাদে একটি সরাইখানা ও হাম্মামখানা নির্মাণ করান। জাহানারার শেষ নির্মাণযজ্ঞ ছিল একটি বাগান এবং এটি ব্যক্তিগত। ৫০ একর জায়গা নিয়ে তিনি তৈরি করেন, এর নাম ছিল সাহেবাবাদ। দেয়াল দিয়ে ঘেরা এই বাগানের চার কোণে ছিল চারটি টাওয়ার, ছিল বাগান, পুকুর।&dquote;&dquote;

সম্রাট শাহজাহানের অন্য কন্যা শাহজাদী রোশনারা বেগম শাহজাহানাবাদে একটি মাত্র স্থাপনা তৈরি করিয়েছিলেন—একটি বড় বাগান—রোশনারাবাগ। বাগানটি এখনো রোশনারার বাগান নামে পরিচিত। তবে এ বাগান নির্মাণের দিকে তাকালে সে সময় বড় বোনের সঙ্গে রোশনারার দূরত্ব, সম্পর্কের টানাপড়েন টের পাওয়া যায়। জাহানারা সাহেবাবাদ থেকে যতটা সম্ভব দূরে নিজের বাগান তৈরি করেছিলেন। সাহেবাবাদ থেকে রোশনারাবাগের দূরত্ব ছিল চার কিলোমিটার এবং শাহজাহানাবাদের সীমানাদেয়ালের বাইরে। সেখানে তিনি নিজের সহচরী, গায়িকা, নতর্কীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এবং বড় বোনের চোখ ধাঁধানো ক্ষমতা, জৌলুসকে কিছু সময়ের জন্য ভুলে থাকতে চেষ্টা করতেন।

বেগম সাহেবা নামে পরিচিত জাহানারা বেগম কাশ্মীরে কারুকাজ করা একটি মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। মসজিদটি জাহানারা নির্মাণ করেছিলেন সে সময়ের একজন জ্ঞানী মানুষ মোল্লা শাহ বাদাকশানীর জন্য। মসজিদটি ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছিল বেশ বড় ভবন। এ ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল গরিবদের থাকার জন্য। মসজিদ ও গরিবদের আবাস—দুটোরই খরচ জাহানারা নিজের অর্থ থেকে দিয়েছিলেন।

মোগল শাহজাদীদেরর মধ্যে শেষ দুই উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের দুই কন্যা জেব-উন-নিসা ও জিনাত-উন-নিসা। বড় কন্যা জেব-উন-নিসার জন্ম ১৬৩৮ সালে দৌলতাবাদে। আওরঙ্গজেব তখন দাক্ষিণাত্যের গভর্নর। জেব-উন-নিসা দিল্লির দরবার থেকে দূরে দাক্ষিণাত্যেই বড় হচ্ছিলেন। শাহজাদী জেব-উন-নিসা শিক্ষা পেয়েছিলেন হাফিজা মরিয়ম বিবির। তিনি ছিলেন কাশ্মীরের মির্জা শুকরুল্লাহর স্ত্রী। তারা ভারতে এসেছিলেন ইরানের খুরাসা থেকে। জেব-উন-নিসার আরেকজন শিক্ষিকা ছিলেন, যার নাম ছিল মিয়া বাই। তার কাছ থেকে তিনি গণিত, আরবি ও জ্যোতির্বিদ্যা শিখতেন।

কথিত আছে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিদূষী কন্যা জেব-উন-নিসা সাত বছর বয়সেই কোরআনে হাফেজ হয়েছিলেন। আর খুশিতে তার গর্বিত পিতা আওরঙ্গজেব দিল্লির বড় ময়দানে তার সেনাবাহিনীকে ভোজ খাইয়েছিলেন, গরিবদের ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দান করেন এবং সরকারি দপ্তরের জন্য দুদিন ছুটি ঘোষণা করেন। জেব-উন-নিসা পুরস্কার হিসেবে পান ৩০ হাজার আশরাফী। আওরঙ্গজেবের আরেক কন্যা জিনাত-উন-নিসারও ইসলামের তাত্ত্বিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান ছিল।&dquote;&dquote;

১৬৫৮ সালে আওরঙ্গজেব বড় ভাই দারা শুকোকে হত্যা ও পিতা শাহজাহানকে বন্দি করে মোগল সিংহাসনে আরোহণ করেন। জেব-উন-নিসার বয়স তখন ২০। আওরঙ্গজেবের প্রধান স্ত্রী দিলরাস বানু বেগমও তখন বেঁচে নেই। ফলে মোগল রাজকীয় জেনানার দুই কর্ত্রী হয়ে উঠলেন আওরঙ্গজেবের বোন রোশনারা ও কন্যা জেব-উন-নিসা। পরবর্তী ২০ বছর জেব-উন-নিসা শাহজাহানাবাদের অন্যতম প্রভাবশালী নারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

জেব-উন-নিসার মূল আগ্রহ ছিল কবিতা ও সাহিত্যচর্চা। তাকে সে যুগের অন্যতম সেরা কবি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তিনি ফারসি ক্যালিগ্রাফি বিশেষত নাস্তালিক, মাসখ ও শিকাস্তা লিখতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি পাণ্ডুলিপি ও বই সংগ্রহ করতেন। তার গ্রন্থাগারটি ছিল তখনকার ভারতের অন্যতম সমৃদ্ধ একটি। পিতা আওরঙ্গজেব যখন সংগীত ও কাব্য থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন, তখন এই শাহজাদী, অনেক শাহজাদা ও অভিজাতরা সেগুলোকে চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। শাহজাদী জেব-উন-নিসা বেগম গান গাইতেন। পোশাকে নকশার ব্যাপারেও তার দারুণ আগ্রহ ছিল।

জেব-উন-নিসা নিজে সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি লেখক ও কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। মুল্লা সফিউদ্দিন আদবেলি যখন তফসির-ই-কবির আরবি থেকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করছিলেন, তখন জেব-উন-নিসা তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। এ অনুবাদ মুল্লা সফিউদ্দিন শাহজাদীকে উৎসর্গ করেন—জেব-উত-তাফাসির। জেব-উন-নিসা মুহাম্মদ সাফি কাজয়িনির জযাত্রার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কাজয়িনি তার ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখেছিলেন, যা অভিনব ও দারুণ অলংকরণসমৃদ্ধ। বইটি তিনি জেব-উন-নিসাকে উৎসর্গ করেছিলেন। আওরঙ্গজেব আফিম ও মদ নিষিদ্ধ করার পরপর দরবারে পুরষদের জন্য মদপান বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তখনো জেনানা মহলে মদের ব্যবহার ছিল, বিশেষ করে তাদের বাগানের আঙুর দিয়ে তৈরি মদের।

মোগল বংশীয় নারীরা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের বিরাট অংশ ব্যয় করতেন শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, জ্ঞানী মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং বই সংগ্রহে। গুলবদন বেগমের নিজস্ব পাঠাগার ছিল, যেখানে অনেক দুর্লভ বই ছিল। জেব-উন-নিসারও ছিল নিজস্ব পাঠাগার এবং মূল্যবান বই অনুলিপি করার জন্য তিনি দক্ষ ক্যালিগ্রাফার নিয়োগ দিয়েছিলেন।&dquote;&dquote;

জেব-উন-নিসা তার ছোট ভাইবোনদের বিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন। তার ছোট বোন জুবদাত-উন-নিসার বিয়ে হয়েছিল দারা শুকোর ছোট ছেলে সিফির শুকোর সঙ্গে আর মেহর-উন-নিসার বিয়ে হয় মুরাদ বকশের পুত্র ইজাদ বকশের সঙ্গে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের দুই জ্যেষ্ঠ কন্যাদ্বয়কে বিয়ে করার জন্য আর কোনো চাচাতো ভাই অবশিষ্ট ছিল না। এছাড়া আরেকটি বিষয়ও সে সসময় কাজ করত। তিমুর বংশীয় শাহজাদী, তাদের পূর্বসূরিদের মতো আওরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ কন্যারাও জেনানা মহলের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকুন, এটাই ছিল রীতি-রেওয়াজের দাবি।

কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির নানা উত্তেজনাকর ঘটনা সবসময়ই মোগল বংশকে ছুঁয়ে গেছে। আওরঙ্গজেব যেমন তার ভাইদের হত্যা ও পিতাকে বন্দি করে সিংহাসনে বসেছিলেন, তেমনি তাকেও ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের পুত্রদের বয়স বাড়ছিল, তারা নিজেরা সিংহাসনে বসার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু আওরঙ্গজের ছিলেন ক্ষমাহীন। পুত্রদের এমন যেকোনো তত্পরতাকে তিনি কঠোরহস্তে দমন করেছিলেন। ১৬৮১ সালে পুত্র মুহাম্মদ আকবর রাজপুত মিত্রদের নিয়ে পিতাকে চ্যালেঞ্জ করলেন। এ ঘটনায় জড়িয়ে গেলেন জেব-উন-নিসা। এ বছরই জাহানারা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রায় অর্ধশতক সময় ধরে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে মোগল পরিবারকে সামলেছেন। তারপর জেব-উন-নিসা নিজেকে বাদশাহ বেগম হওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেছিলেন। সুফিবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াও জেব-উন-নিসা জাহানারার মতো নানা গুণে গুণান্বিতা ছিলেন। মুহাম্মদ আকবর যখন পিতাকে চ্যালেঞ্জ করলেন, তখন আওরঙ্গজেবের বয়স ৬৩ বছর। নিজে বাদশাহ বেগম হওয়া নিশ্চিত করতে এবং দরবারি রাজনীতির হিসাব-নিকাশ করে জেব-উন-নিসা ভাই আকবরের পক্ষ নেন।

আওরঙ্গজেব তার স্বভাবসুলভ চাতুরী ও কৌশল ব্যবহার করে পুত্রকে পরাজিত করতে সমর্থ হন। একই সঙ্গে তিনি পুত্র আকবরকে সমর্থন করে জেব-উন-নিসার লেখা কিছু চিঠি উদ্ধার করেন। পিতার কাছে পরাজিত হয়ে মুহাম্মদ আকবর পারস্যে পালিয়ে যান এবং জেব-উন-নিসাকে দিল্লির সালিমগড় দুর্গে বন্দি করা হয়। তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয় এবং বার্ষিক ৪ লাখ রুপির পেনশনও বাতিল করা হয়।

আকবরের বিদ্রোহের পর আওরঙ্গজেব শাহজাহানাবাদ ছেড়ে দাক্ষিণাত্যে চলে যান এবং তিনি আর কখনো দিল্লিতে ফিরে আসেননি। আওরঙ্গজেব সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাকি পুত্র ও জেনানা মহলকে। ধীরে ধীরে অভিজাত, সৈন্য, বণিক, কারিগর সবাই শাহজাহানাবাদ ত্যাগ করলেন। জেব-উন-নিসা আরো ২০ বছরের বেশি সময় বেঁচে ছিলেন। তবে সময়টা তার সালিমগড় দুর্গে বন্দি অবস্থায়ই কেটেছে। অন্যরা ছেড়ে গেলেও কবি ও সংগীতশিল্পীরা শাহজাহানাবাদের মায়া ছাড়তে পারেননি। ধনী অভিজাতরা চলে গেলেও শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার ভূমিকা নিলেন এবার সাধারণ মানুষই। সময়ের এই বদলকে এক কবি পরবর্তী সময়ে লিখেছিলেন—

একসময় যে হাতিতে চড়ত, সে এখন খালি পায়ে হাঁটে। একদা যারা এক মুঠো শস্যের জন্য আকুতি জানাত, তারা এখন বিলাসবহুল ভবন আর হাতির মালিক। সিংহের মর্যাদা এখন শিয়ালের গলায়।

জেব-উন-নিসা তার ভাই মুহাম্মদ আকবরের সিংহাসনে বসার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ১৭০৩ সালে আকবর পিতা আওরঙ্গজেবের আগেই মারা যান। যমুনার তীরে বন্দিশালায় বসে জেব-উন-নিসা শাহজাহানের প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। এ সময় তিনি কবিতা লিখতেন ছদ্মনাম মাখভি নিয়ে। পিতার ক্ষমা ছাড়াই ১৭০২ সালে জেব-উন-নিসা প্রয়াত হন।

আওরঙ্গজেবের কনিষ্ঠ কন্যা ছিলেন জিনাত-উন-নিসা। জেব-উন-নিসা পিতার নির্দেশে বন্দি হওয়ার পর জিনাতই হন মোগল বাদশাহীর জেনানার বাদশাহ বেগম। আওরঙ্গজেবের নির্দেশেই জিনাত এ সম্মান পেয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

জিনাত-উন-নিসা কবি না হলেও কবিতা লিখতেন। তিনি তার জ্ঞান ও দানশীলতার জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন। মোগল স্থাপত্যে নারী হিসেবে তিনিই শেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। নিজে ১৭টি সরাইখানা নির্মাণ করিয়েছিলেন তিনি। নিজের খরচে দিল্লিতে একটি দর্শনীয় মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন জিনাত। মসজিদটি জিনাত-উল-মসজিদ নামে পরিচিত।

জিনাত-উন-নিসার জীবন কেটেছে একাকী। ফুপু জাহানারা, বড় বোন জেব-উন-নিসাকে হারিয়ে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। একই সঙ্গে তার চোখের সামনেই মোগল সাম্রাজ্য তার শক্তি, জৌলুস হারিয়ে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিল। পিতার মৃত্যুর পরও তিনি দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর জিনাত তার জীবদ্দশায় সাতজনকে সম্রাট হতে দেখেছেন। খুনোখুনি, অন্ধ করে দেয়ার মতো ঘটনা হয়েছে সিংহাসন দখল নিয়ে। তার দেখা শেষ সম্রাট ১৭ বছর বয়সী মুহাম্মদ শাহ রঙ্গিলা। আর জিনাতের বয়স তখন ৭৬। মোগল সাম্রাজ্যের শেষ বাদশাহ বেগম জিনাত-উন-নিসা প্রয়াত হন ১৭২১ সালে। নিজ চোখে দেখে যান দুনিয়ার অন্যতম এক শাসক বংশ আর সাম্রাজ্যের গৌরব, ক্ষমতার ক্ষয়।

মধ্যযুগের ভারতে হিন্দু বা মুসলমান যে ধর্মের পরিবারই হোক না কেন, নারীশিক্ষায় উৎসাহী ছিল না। কঠোর পর্দা প্রথা আর সমাজে নারীদের আলাদা করে রাখার প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের শিক্ষা সে সময় বেশ কঠিন ব্যাপার ছিল। প্রাথমিক শিক্ষা ছেলেমেয়েরা একসঙ্গেই পেত, আবার মেয়েদের জন্য পৃথক মাদ্রাসা বা মক্তবও ছিল। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হওয়ার পর নারীশিক্ষা শুধু রাজকীয়, ধনী আর অভিজাত পরিবারেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ত। দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের মেয়েরা এক রকম অশিক্ষিতই থেকে যেত।

মোগল সম্রাটদের প্রায় সবারই জ্ঞানার্জনে আগ্রহ ছিল। তারা তাদের কন্যাসহ সব সন্তানকে শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। সম্রাট আকবর নিজে শিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু শিক্ষার প্রতি তার ছিল অসীম আগ্রহ। মোগল রাজকন্যা ও রাজপরিবারের মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারেও আকবর উৎসাহী ছিলেন। কথিত আছে, মেয়েদের স্কুলের জন্য আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে বেশকিছু কক্ষ নির্মাণ করেছিলেন এবং কয়েকজন শিক্ষিকা নিয়োগ দিয়েছিলেন। আকবরের দরবারে থাকা জেসুইট মিশনারি অ্যান্টোনিও মনসারেট বলেছেন, ‘শাহজাদীদের শিক্ষার ব্যাপারে আকবর খুবই যত্নবান ছিলেন...তাদের তত্ত্বাবধায়িকারা লিখতে-পড়তে এবং অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন।’ আওরঙ্গজেবের ব্যাপারে বাখতাওয়ার খান লিখেছেন, ‘সম্রাট অভিজাতদের সন্তানদের উদার শিক্ষা দিতেন...এমনকি গৃহস্থালির কাজ যেসব নারী করতেন, তাদেরও সম্রাটের নির্দেশে ধর্মের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়া হতো।’ বাবর, হুমায়ূন, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানও শাহজাদী ও রাজকীয় নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে দরকারি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

মোগল শাহজাদীদের শিক্ষা দেয়া হতো প্রাসাদের ভেতরে। সাধারণত শিক্ষিত গৃহশিক্ষিকা বা বয়স্ক জ্ঞানী শিক্ষক তাদের শিক্ষা দিতেন। শিক্ষিকারা সাধারণত একই সঙ্গে শাহজাদীদের পরিচারিকারও কাজ করতেন। তাদের সাধারণভাবে ডাকা হতো অতুন নামে। আবার অনেককে ডাকা হতো অতুন মামা নামে। গুলবদন বেগমের হুমায়ূননামায় এমন একজন অতুন মামার কথা উল্লেখ আছে। শাহজাদী জাহানারার শিক্ষিকা ছিলেন পারস্যের উচ্চশিক্ষিত নারী সাতি-উন-নিসা। তিনি সুন্দর কোরআন পড়তে পারতেন এবং ফারসি ভাষায় তার খুব ভালো দখল ছিল। সাতি-উন-নিসার পরিবারের অনেকেই ছিলেন চিকিৎসক। তার ভাই তালিবা আমুলি জাহাঙ্গীরের দরবারে ‘কবিদের রাজপুত্র’ উপাধি পেয়েছিলেন।

গৃহস্থালি বিদ্যা ও সুচিকর্মের পাশাপাশি মোগল রাজপরিবারের মেয়েদের কবিতা, মানবিক বিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব ও ভাষা (আরবি, ফারসি) শেখানো হতো। হারেমে মোগল বংশীয় নারীরা ব্যবহার করতেন তুর্কি ভাষা আর ভারতের হিন্দু বা ভারতীয় বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা নারীরা ব্যবহার করতেন হিন্দি বা স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষা। কবিতা আর সাহিত্যের ভাষা ফারসিতে ভালো দখল থাকাটাকে সাফল্য বলে বিবেচনা করা হতো। নারীরা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রতিযোগিতা করতেন সম্রাটকে খুশি করতে। মোগল নারীদের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুচ্চি জানান, তাদের যারা লিখতে-পড়তে শেখাতেন, তারা মাঝে মাঝে তাদের প্রেমের কবিতা পড়তে বলতেন। আর তা না হলে অবসরে তারা ইরানের শেখ সাদী সিরাজীর ‘গুলিস্তাঁ’ ও ‘বোস্তাঁ’ পড়তেন।

শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় শিক্ষা মোগল শাহজাদা-শাহজাদীদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো কোরআনশিক্ষাকে। মোগল দরবারের অভিজাতদের একজন ছিলেন পারস্যের গিয়াস বেগ। গিয়াসের কন্যা মেহেরুন্নিসা শিশু বয়সে আগ্রায় মোগল শাহজাদীদের সঙ্গেই বড় হয়েছিলেন এবং সেই সূত্রে অল্প বয়সেই তিনি কোরআনশিক্ষা পেয়েছিলেন। এই মেহেরুন্নিসাই পরবর্তী সময়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী নূরজাহান হয়ে ওঠেন।








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.

Post Top Ad

{SCOpenGraph image=http://site.com/link-to-homepage-image.jpg}