এই উপমহাদেশ আমের আদি উৎপত্তিস্থল। তবে ঠিক কখন থেকে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছিল, সে কথা কারো জানা নেই। আনুমানিক হিসাব করলে, কয়েক হাজার বছরতো হবেই। পৃথিবীর মোট উৎপাদিত আমের প্রায় অর্ধেকই হয় ভারতে। এর পরের স্থান দখলকারী দেশগুলোর মধ্যে চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মেক্সিকো, ব্রাজিল, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন। এরপর অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা। ক'বছর আগে আমাদের অবস্থান ছিল অষ্টমে। এখন নবমে।
চীন পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এ অঞ্চলে ভ্রমণে এসে বাংলাদেশের আমকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করেন। ১৩৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে আফ্রিকায় আম চাষ শুরু হয়। এরপর ১৬ শতাব্দীতে পারস্য উপসাগরে, ১৬৯০ সালে ইংল্যান্ডের কাচের ঘরে, ১৭ শতাব্দীতে ইয়েমেনে, উনবিংশ শতাব্দীতে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে আম চাষের খবর জানা যায়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মাটিতে প্রথম আমের আঁটি থেকে গাছ হয়। এভাবেই আম ফলটি বিশ্ববাসীর দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়।
ফজলি, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি, গোপালভোগ, মোহনভোগ, জিলাপিভোগ, লক্ষণভোগ, মিছরিভোগ, বোম্বাই ক্ষীরভোগ, বৃন্দাবনী, চন্দনী, হাজিডাঙ্গ, সিঁদুরা, গিরিয়াধারী, বউভুলানী, জামাইপছন্দ, বাদশভোগ, রানীভোগ, দুধসর, মিছরিকান্ত, বাতাসা, মধুচুসকি, রাজভোগ, মেহেরসাগর, কালীভোগ, সুন্দরী, গোলাপবাস, পানবোঁটা, দেলসাদ, কালপাহাড়সহ চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাওয়া যায় প্রায় ৩০০ জাতের আম। তবে অনেকগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়।
বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে আম গাছকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদ অধিবেশনে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে আম গাছকে নির্বাচন করা হয়। সবচেয়ে দামি ও জনপ্রিয় আমের নাম আলফানসো। ভারতে উৎপাদিত এ জাতের এক কেজি আমের দাম প্রায় ৪০০ রুপি। জাপানের মিয়াজাকি আম সব চেয়ে বেশি দাম, প্রতি কেজি ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ভারতের আম গবেষকরা ১৯৭৮ সালে দশহরি ও নিলাম এ দুটি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে আম উদ্ভাবন করেন; যার নাম আম্রপালি।
বাংলাদেশে অতি উৎকৃষ্ট জাতের মধ্যে হিমসাগরের অবস্থান প্রায় শীর্ষে। হিমসাগর আম জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাকতে শুরু করে এবং পুরো জুন মাস বাজারে পাওয়া যায়। রশাপাতি আমের সঙ্গে হিমসাগর আমের বেশ কিছুটা সাদৃশ্য থাকার কারণে এই আমকে অনেকেই ক্ষীরশাপাতি মনে করে ভুল করে থাকেন। আবার ক্ষীরশাপাতি আমকে হিমসাগর নামে বিক্রি করা হয়। ক্ষীরশাপাতি ও হিমসাগর আমকে আলাদা করা সহজ হবে রঙের পার্থক্য দেখে। পাকার পর ক্ষীরশাপাতি আমের ওপরের অংশ হলুদ রং ধারণ করবে। এ ক্ষেত্রে হিমসাগর আম পাকার পরেও সবুজাভ হালকা হলুদ রঙের হবে।
ফজলি: ১৮০০ সালে মালদহ জেলার কালেক্টর রাজভেনশ এই আমের নামকরণ করেন ‘ফজলি’। কথিত, ফজলি বিবি নামক এক প্রৌঢ়া বাস করতেন স্বাধীন সুলতানদের ধ্বংসপ্রাপ্ত গৌড়ের একটি প্রাচীন কুঠিতে। তাঁর বাড়ির উঠোনেই ছিল একটি আমগাছ। ফজলি এই গাছটির খুব যত্ন নিতেন। এলাকার ফকির বা সন্ন্যাসীরা সেই আমের ভাগ পেতেন।
মুঘল আমলে দ্বারভাঙায় এই প্রকারের আম চাষ শুরু হয়। কিন্তু তখন কেউ এর নাম নিয়ে মাথা ঘামায়নি। পরে আঠারো শতকে এক ফকির খুব সুস্বাদু এই আমের চাষ করেন। সেই ফকিরের পায়ে কিছু সমস্যা ছিল। সেই থেকেই নাকি ওই আমের নাম হয়ে যায় ‘ল্যাংড়া’।
লক্ষ্মণভোগ ও গোপালভোগ: ভারতের ইংরেজবাজারের চণ্ডীপুরের বাসিন্দা লক্ষ্মণ একটি আম গাছ রোপণ করেন। স্বাদে-গন্ধে সেই আম ছিল তুলনারহিত। লক্ষ্মণ চাষির নাম থেকেই লক্ষ্মণভোগ আমের উৎপত্তি। ইংরেজবাজারে নরহাট্টার গোপাল চাষির নামে আবার নাম হয় গোপালভোগের।
গুটি ও আশ্বিনা: চেহারায় ছো়ট এক প্রকারের আম খেয়ে সেই আঁটি নিজের বাগানে পুঁতেছিলেন মালদহের এক দরিদ্র কৃষক। সেই আঁটি থেকেই জন্ম নিয়েছিল আরেক আমগাছ। কাঁচা অবস্থায় টক। কিন্তু পাকলে খুব মিষ্টি। আঁটি বা গুটি থেকে গাছটি জন্মায় বলে আমের নামও হয়ে যায় ‘গুটি’। এ দিকে আশ্বিন মাসে পাকে যে আম তাকে ‘আশ্বিনা’ বলে চেনে বাংলা।
গোলাপখাস: এ আম বিখ্যাত তার গন্ধের জন্য। মিষ্টি গোলাপের গন্ধ বহন করে বলে এই আমকে এই নামে ডাকার চল শুরু হয়ে যায়। প্রাচীন বাংলার আমগুলোর মধ্যে গোলাপখাস অন্যতম। এই আমের গায়ে গোলাপের রঙের লালচে আভা থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন