হজ | হজের ফজিলত - Slogaan BD

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

হজ | হজের ফজিলত

হজের শাব্দিক অর্থ: ‘কোনো মহৎ কাজের ইচ্ছা করা’। পরিভাষায় হজ বলা হয়: ‘র্নিদিষ্ট দিনে হজের নিয়তে ইহরাম অবস্থায় আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করা’। (শামী: ২/৪৫৪)

হজের সূচনা
সর্বপ্রথম পৃথিবীতে হজ পালন করেন হজরত আদম আ.। বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে হজরত আদম আ. আল্লাহতায়ালার নির্দেশে ফেরেশতাদের মাধ্যমে হিন্দুস্থান থেকে পবিত্র মক্কানগরিতে এসে বাইতুল্লাহর ভিত্তি স্থাপন করেন এবং হজ পালন করেন। এরপর থেকেই হজের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। (আইয়ানুল হাজ্জাজ: পৃ. ২২-২৪) আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন- “হজরত আদম আ. যখন পৃথিবীতে অবতরণ করেন তখন তিনি কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করেন। অতঃপর বর্তমানে যেটা মাকামে ইবরাহিম সেখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন এবং কাকুতি-মিনতি করে প্রভূর দরবারে দোয়া করেন।” (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১/১৮৩)


হজরত ইবরাহিম আ. ও তদয় পুত্র হজরত ইসমাঈল আ. কর্তৃক কাবা গৃহ পূণনির্মাণ ও হজের ঘোষণা: হজরত নূহ আ. -এর প্লাবণের পর আল্লাহতায়ালার নির্দেশে হজরত জিবরাঈল আ. -এর মাধ্যমে হজরত ইবরাহিম আ. ও হজরত ইসমাঈল আ. পুনরায় কাবা গৃহ র্নিমাণ করেন। নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে হজের ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা তখন দুনিয়ায় বিদ্যমান এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষের কানে পৌঁছে দেওয়া হয়। আল্লাহতায়ালা কিয়ামত পর্যন্ত যাদের হজ পালন করার সৌভাগ্য লিখে রেখেছেন তারা সবাই সেদিন ইবরাহিম আ.-এর উক্ত অহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলে ছিলেন। যা কুরাআনে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে: ‘আর আপনি মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা করেন তারা আপনার কাছে অনেক দূর-দূরান্ত এলাকা থেকে পায়ে হেটে ও দূর্বল বাহণের উপর আরোহণ করে আসবে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, সূরা হজ: ২৭)

হজ ফরজ হওয়ার সময়: 
হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। যা নবম হিজরিতে ফরজ হয়। পবিত্র কুরআনে মহানপ্রভূ ইরশাদ করেন: ‘ আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এই গৃহের হজ করা সেই সকল লোকদের ওপর কর্তব্য যারা সফর করার আর্থিক সামার্থ্য রাখে’ (সূরা আলে ইমরান: ৯৭)

হজ কতবার ফরজ এবং তা তৎক্ষণাত আদায় ফরজ না বিলেম্বে?
 হজ জীবনে একবারই ফরজ। আর তা তৎক্ষণাতেই আদায় করা কতর্ব্য, বিলম্বে নয়। বারবার হজ ফরজ নয়, হ্যাঁ তবে যদি কেউ নফল হিসেবে করতে চাই তাহলে তার ব্যাপার ভিন্ন। ইবনে আব্বাস রা. ইরশাদ করেন, একবার রাসূলে কারিম সা. আমাদেরকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন: ‘‘হে লোকসকল! আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন। তখন হজরত আকরাহ ইবনে হাবেস রা. দাঁড়িয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! হজ কি আমাদের ওপর প্রত্যেক বছরই ফরজ? নবি কারিম সা. বললেন, যদি আমি হ্যাঁ বলে দিতাম তাহলে তা প্রত্যেক বছরই তোমাদের উপর ফরজ হয়ে যেত। কিন্তু তা সাধ্যাতিত হওয়ায় তোমরা তাতে আমল করতে না। সুতরাং তোমাদের যাদের সামর্থ্য রয়েছে তার ওপর একবার হজ ফরজ, বাকি নফল।’’ (আবু দাউদ: ১৭২১)

হজ ফরজ হওয়ার শর্তাবলী
মুসলমান হওয়া, হজ ফরজ হওয়া সর্ম্পকে অবগত থাকা, বালেগ তথা পাপ্ত বয়স্ক হওয়া, জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া, হজের মাস উপস্থিত হওয়া। (গুনিয়াতুন নাসেক: ১২-২২)

হজের প্রকারভেদ
হজ তিন প্রকার: ১. হজ্জে ইফরাদ ২. হজ্জে তামাত্তু ৩. হজ্জে কেরান।

হজ্জে ইফরাদ বলা হয়: একই সফরে শুধুমাত্র হজের নিয়তে ইহরাম বাঁধা, ওমরার নিয়ত না করা। অথাৎÑ ওমরা পরবর্তিতে করার নিয়ত করা।
হজ্জে তামাত্তু বলা হয়: একই সফরে হজ ও ওমরার নিয়ত করা, এবং এর জন্য আলাদা আলাদা ইহরাম বাঁধা। অর্থাৎÑ প্রথমে ওমরার জন্য ইহরাম বাধাঁ তারপর হালাল হয়ে পুনরায় হজের জন্য ইহরাম বাঁধা।

হজ্জে কেরান বলা হয়: একই সফরে হজ ও ওমরার নিয়ত করা, এবং উভয়ের জন্য একসাথে ইহরাম বাঁধা। অর্থাৎÑ একই ইহরামে হজ ও ওমরা পালন করা। তাতে একটু কষ্ট বেশী হলেও সাওয়াবের দিক দিয়ে তা পূর্বের দুই প্রকারের চেয়ে অধিক শ্রেয়।

হজের ফরজসমূহ: (ক) মীকাত অতিক্রম করার পূর্বেই ইহরাম বাঁধা। (খ) নবম জিলহজ জোহরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ওকুফে আরাফা বা আরাফার প্রান্তরে অবস্থান করা। (গ) ১০, ১১ অথবা ১২ই জিলহজ কাবা শরীফের তাওয়াফে জিয়ারত করা। উক্ত তিনটি ফরজের কোন একটিও ছুটে গেলে, হজ সহীহ হবে না। এমনকি দম তথা পশু কুরবানী করলেও তা পূরণ হবে না।

হজের ওয়াজিব সমূহ: (১) ‘নবম জিলহজ ওকুফে মুযদালিফা বা মুযদালিফার প্রান্তরে অবস্থান করা। (২) সাফা মারওয়া সায়ী করা বা দৌঁড়ানো। (৩) মিনায় ১০ই জিলহজ শুধু জামরায়ে আকাবা তথা শেষ স্তম্ভে রমি বা পাথর নিক্ষেপ করা। এবং ১১ ও ১২ ই জিলহজ রমিয়ে জিমার অর্থাৎÑ পর্যায়ক্রমে জামরায়ে উলা ও জামরায়ে উস্তা এবং জামরায়ে আকাবা এ তিনটি স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ করা। (৪) তামাত্তু ও কেরান হজ পালনকারীর হজের শুকরিয়া কুরবানী আদায় করা। (৫) ইহরাম খোলার জন্য মাথা মুন্ডানো অথবা চুল অন্তত দুই আঙ্গুল পরিমাণ খাটো করা। (৬) তাওয়াফে বিদা তথা বিদায়ী তাওয়াফ করা।’ বর্ণিত ওয়াজিবসমূহের কোনো একটি ছুটে গেলে, হজ সহীহ হয়ে যাবে বটে, কিন্তু সেজন্য দম দিতে হবে তথা একটি বকরি, ভেড়া বা দুম্বা জবাই করে সদকা করে দেওয়া।

হজের সুন্নাতসমূহ: (১) তাওয়াফে কুদুম বা মক্কায় প্রবেশকালে সর্বপ্রথম তাওয়াফ। (২) তাওয়াফের ক্ষেত্রে রমল করা তথা খুব জোরে জোরে হাটা। (৩) অষ্টম জিলহজ মিনায় গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা এবং সেখানে রাত্রিযাপন করা। (৪) নবম জিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা হতে আরাফার ময়দানে গমণ করা। (৫) ওকুফে আরাফার জন্য সেদিন জোহরের পূর্বে গোসল করা। (৬) ওকুফে আরাফা শেষ করে সেদিন সূর্যাস্তের পর মুযদালিফার দিকে রওয়ানা হওয়া। (৭) মুযদালিফায় ঐ দিন রাত্রি যাপন করা। (৮) মিনায় রমি সম্পাদন কালে অর্থাৎ ১০, ১১, ১২ই জিলহজ রাত্রি যাপন করা। (৯) রমি শেষে মিনা হতে মক্কায় প্রত্যাবর্তন কালে পথে মুহাসসাব নামক স্থানে কিছু সময় অবস্থান করা। (১০) ইমামের জন্য তিন স্থানে খুৎবা দেওয়া: ১. ৭.ই জিলহজ মক্কায়। ২. ৯ই জিলহজ আরাফায়। ৩. ১১ই জিলহজ মিনায়।

হজের গুরুত্ব ও তাৎর্পয 
হজ ইসলামের স্তম্ভসমূহের মধ্য হতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যা প্রভু ভূক্তির এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। যাদের উপর হজের সামর্থ্য রয়েছে তাদের উপর একান্ত জরুরী হলো যাবতীয় প্রয়োজন পরিত্যাগ করে প্রভূ প্রেমে সাড়া দিয়ে হজ করা। এক্ষেত্রে বিলম্বের কোন অবকাশ নেই। কারণ রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন: “যে ব্যাক্তি হজ করার ইচ্ছে করে সে যেন তা তাড়াতাড়ি আদায় করে নেয়। কারণ যেকোন সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে অথবা অন্য কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।”(আবু দাউদ: ১৭৩২)

হজের ফজিলত
হজ প্রভু প্রেমে সাঁড়া দেওয়ার এক অনন্য নিদর্শন। যা মহান প্রভুর নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয়। যার ফজিলত ও মর্যাদা অনেক বেশী। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আমি নবি কারিম সা. কে বলতে শুনেছি: ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুটির উদ্দেশ্যে হজ করল এবং অশ্লীল কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকল সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ থেকে ফিরে আসবে যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়েছিল।’’ (বুখারী: ১৫২১) অন্যত্রে আছেÑ ‘‘যে ব্যক্তি হজের উদ্দেশ্যে বের হল, অতঃপর মৃত্যুবরণ করল, কিয়ামত পর্যন্ত তার হজের সাওয়াব লেখা হবে।’’ (তবরানী: ৫৪৮০)

তালবিয়া পাঠ ও তার ফজিলত: তালবিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আল্লাহ পাকের নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয় আমল। আবু বকর সিদ্দিক রা. হতে বর্ণিত- নবি কারিম সা. কে জিজ্ঞেস করা হল, ‘‘কোন হজ সর্বোত্তম? তিনি বললেন, যে হজে উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা হয় এবং কুরবানী করা হয়।’’ (তিরমিজি: ৮২৭)

বাইতুল্লাহর তাওয়াফ ও তার ফজিলত
তাওয়াফ হজের একটি অন্যতম বিধান। তাওয়াফ হলো, বাইতুল্লাহ শরীফকে সাতবার প্রদক্ষিণ করা। ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি- “যে ব্যক্তি যথাযথভাবে সাতবার বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করে এবং দুই রাকাত সালাত আদায় করে তার একটি গোলাম আজাদ করার সমান সাওয়াব হয়। তাওয়াফের প্রতি কদমে আল্লাহতায়ালা তার একটি করে গুনাহ মাফ করেন, একটি করে নেকী লেখেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।” (আহমদ: ৪৪৬২)

হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করার ফজিলত
হজের অন্যতম আরেকটি আমল হলো, হাজরে আসওয়াদকে চুমু খাওয়া ও রুকনে ইয়ামানি স্পর্শ করা। যা হজের কার্যসমূহের মধ্যে অত্যন্ত আর্কষণীয় ও প্রতিযোগিতা মূলক একটি কাজ। কেননা প্রত্যেক হাজীর মনেই এই তামান্না বা কামনা থাকে যে আমি হাজরে আসওয়াদ ধরে চুমু খাবো, এবং মনভরে মহান প্রভুর কাছে নিজের পাপের জন্য ক্ষমা পার্থনা করব। ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেন, আমি রাসূল সা. -কে বলতে শুনেছি, “হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানির স্পর্শ পাপসমূহকে মুছে দেয়।” (তিরমিজি: ৯৫৯)

আরাফার ময়দানে অবস্থান করা
হজের অন্যতম আরেকটি কাজ হলো, আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। ধনী-গরিব সকলেই এক কাপড়ে প্রভুর প্রেমে আসক্ত হয়ে তার সান্নিধ্য লাভের আশায় আরাফার খোলা প্রান্তরে ধ্যানমগ্ন থাকেন। হজরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন: ‘‘আরাফার দিন অপেক্ষা এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ তায়ালা অত্যাধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন এবং তিনি নিকটবর্তী হন। আর ফেরেশতাদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, এরা কী চায়? ’’ (মুসলিম: ১৩৪৮)

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ: (১) যে কোনো রকমের গুনাহ করা। (২) স্ত্রী সহবাস বা এ জাতীয় অন্য কিছু করা। (৩) সুগন্ধি যুক্ত আতর, বা তৈল, অথবা খাবার ইত্যাদি গ্রহণ করা। (৪) সেলাই যুক্ত কাপড় পরিধান করা। (৫) পুরুষের জন্য মাথা, মুখ ঢেকে রাখা। (৬) নখ, চুল বা পশম কাটা। (৭) বন্য পশু শিকার করা। (৮) উকুন মারা। (৯) মেয়েদের জন্য হাতে মেহেদী লাগানো। (কিতাবুল মাসায়েল: ৩/১৫৭)

লেখক: অধ্যাপক আল মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ (এ এম আই)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.

Post Top Ad

{SCOpenGraph image=http://site.com/link-to-homepage-image.jpg}