২৩ জুন, এই দিনটি বাংলাদেশর মুসলিম সমাজের জন্য অত্যন্ত শোকাবহ এবং হৃদয়বিদারক দিন। ১৭৫৭ সালের এইদিনে পলাশীর আ¤্রকাননে কতিপয় বিশ্বাসঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা হারায় এবং পাক-ভারত উপমহাদেশ দু’শ বছরের জন্য ইংরজেদের পদানত হয়। এক সময় বাংলাদেশ মোঘল সা¤্রাজ্যেরে অন্তর্গত একটি প্রদেশ ছিল। এই অঞ্চল মোঘল স¤্রাটদের নিযুক্ত সুবেদার কর্তৃক শাসিত হতো। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে মোঘল স¤্রাট আওরঙ্গজেবের ইন্তেকালের পরপরই মোঘল সা¤্রাজ্যের অবনতি ও পতনের ধারাবাহিকতা শুরু হয়।
আওরঙ্গজেবের ইন্তেকালের পর মোঘল স¤্রাটদের দুর্বলতার কারণে ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খান দুর্বল মোঘল স¤্রাটদের ব্যর্থ শাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করে স্বাধীন নবাবী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব মুর্শিদকুলী খানের ইন্তেকালের পর তার ছেলে সুজাউদ্দীন খান বাংলার সিংহাসনে আরোহন করলে উড়িষ্যার সাথে বাংলা একীভূত হয় এবং পরবর্তীতে তার ধারাবাহিকতায় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা এক নতুন সা¤্রাজ্যে পরণিত হয়।
সুজাউদ্দীনের ইন্তেকালের পর তার ছেলে সরফরাজ খান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হলে সরফরাজ খানের ব্যর্থতার সুযোগে বিহারের শাসনর্কতা আলী বর্দী খাঁ পরের বছর ১৭৪০ সালে সরফরাজ খানকে পরাজতি করে একজন কঠোর এবং দক্ষ শাসক হিসেবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হন। নবাব আলী বর্দী খাঁর শাসনামলে মারাঠা বর্গীরা বারবার বাংলা আμমণ ও লুণ্ঠন চালায়। মারাঠা বর্গীদের আμমণে বাংলায় দুর্দশা নেমে আসে। নবাব আলী বর্দী খাঁ তরুণ সিরাজউদ্দৌলাকে সাথে নিয়ে ১৭৪৬ সালে মারাঠা বর্গীদের বিরুদ্ধে সামরকি অভিযান পরিচালনা করে কঠোর হাতে তাদের দমন করেন। ১৭৫১ সালে তিনি মারাঠাদের বিতাড়িত করেন। মারাঠা আμমণের কারণে বাংলায় যে অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয় তার জন্য নবাব আলী বর্দী খাঁ বাংলায় ইংরেজদের বাণিজ্য করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করতে পারননি যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে তিনি বাণিজ্য করার অনুমতি দিয়েছেন তারাই পরবর্তীতে বাংলার স্বাধীনতাকে বিপনড়ব করতে পারে।
নবাব আলী বর্দী খাঁর কোনো ছেলে সন্তান ছিল না। ১৭৫৬ সালের এপ্রিলে নবাব আলী বর্দী খাঁর ইন্তেকালের পর তার প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব হন। সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসার পর থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করতে। আলী বর্দী খাঁর এক কন্যা ঘষেটি বেগম এবং ক্ষমতালোভী নিকটাত্মীয় সেনাপতি মীর জাফর সিরাজের সিংহাসন লাভকে মেনে নিতে পারেননি। এছাড়াও ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে ছিলেন রাজা রাজবল্লব, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণবল্লভ, মানিক চাঁদ, আমির চাঁদ, আমির বেগ, খাদিম হোসেন, ইয়ার লতিফ খান, ওয়াটস, নবকুমার। সেই সময়ে বেশ কিছু বর্ণ হিন্দু শেঠ বেনিয়া, এক শ্রেণীর রাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জমিদারগণ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অপসারণ করতে ষড়যন্ত্রকারীদের মদদ দেয়।
ঘষেটি বেগম চেয়ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অপসারণ করে তার ছেলে শওকত জংকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব বানাতে। এর ফলশ্রুতিতে শওকত জং বিদ্রোহ শুরু করলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তা কঠোর হাতে দমন করনে। পক্ষান্তরে হিন্দু সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জমিদাররা অনুভব করেছিলো যে, ইংরেজদের সহায়তায় মুসলিম শাসনের পতন ঘটিয়ে হিন্দু রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। একপর্যায়ে ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে হাত মেলায় এবং মীরজাফরকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব বানাতে কাশিমবাজার কুঠরিতে মীরজাফর-ক্লাইভের মধ্যে এক গোপন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই গোপন চুক্তির ধারাবাহিকতায় আসে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। পলাশীর আ¤্রকাননে ভাগিরথী নদীর তীরে উভয় পক্ষ সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। নবাব বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার এবং পক্ষান্তরে ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ হাজার। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সেনাপতি মোহনলাল, মীরমদন ও ফরাসী সেনানায়ক সিনফ্রে যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু প্রধান সেনাপতি মীর জাফর তার সৈন্যদের নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। একপর্যায়ে ইংরেজদের কামানের গোলার আঘাতে মীরমদন শাহাদাৎ বরণ করেন।
বিজয় যখন সনিড়বকটে, তখন প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের একটি কথায় নবাব সিরাজ যুদ্ধবিরতির আদেশ দিলে পিছন থেকে ইংরেজ বাহিনী নবাব বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভসহ কুচμিরা হাতির ওপর বসে যুদ্ধ উপভোগ করছিলেন। ফলে অসহায় নবাব পরাজিত হয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে যান। মাত্র ১৭ জন দৃঢ়চেতা, সাহসী, সংগ্রামী ও স্থির-প্রতিজ্ঞ যোদ্ধা নিয়ে যে বাংলায় ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেছিলেন, সাড়ে পাঁচশ’ বছর পর ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার মুখে সেই শাসনব্যবস্থা ধ্বংস হয়। পরবর্তীতে পরাজিত নবাব সিরাজউদ্দৌলা সপরিবারে নৌকাযোগে বিহারের দিকে যাওয়ার সময় মীর কাসেমের হাতে বন্দি হন।
অবশেষে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের ছেলে মীরনের নির্দেশে জাফরগঞ্জের এক কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় মোহাম্মদী বেগ তার নাঙা তলোয়ার দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে সিরাজের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে। লুটিয়ে পড়েন বাংলার শেষ মুসলিম শাসক নবাব সিরাজউদ্দৌলা। এরপর মীরজাফর পুতুল নবাব হন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইংরেজদের হাতে। পলাশী ট্র্যাজেডির পর বাংলার মুসলিমদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে নেমে আসে অস্থিরতা ও মারাত্মক বিপর্যয়। চাকরি, জমিজমা ও সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে মুসলিমরা। ইংরেজরা ঘুষ, লুণ্ঠন ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের লুণ্ঠিত সম্পদ দিয়ে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে গ্রেট ব্রিটেন একটি শীর্ষ সম্পদশালী দেশে পরিণত হয়।
যাই হোক, পলাশীর ট্র্যাজেডির ধারাবাহিকতায় যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল তা আজও থেমে নেই। সেই মীর জাফর-জগৎশেঠ গংদের প্রেতাত্মারা বাংলাদেশের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। তারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ইসলামকে বিপনড়ব করে দেশকে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের সেবাদাসে পরিণত করতে চায়। আজ সময় এসেছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার উত্তরসূরিদের জাগ্রত হয়ে নব্য মীর জাফর-জগৎশেঠদের নির্মূল করা। এজন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন