বিহার দাঙ্গা - Slogaan BD

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

বিহার দাঙ্গা

 দেশভাগ নিয়ে যেটুকু যা চর্চা করেছি, তাতে আমার অন্তত মনে হয়েছে ১৯৪৭-এর ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে আমাদের যে অর্জন বা স্বাধীনতা প্রাপ্তি, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অবাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী।


পাশাপাশি অদ্ভুত কারণে আমরা নীরব থাকি একদা পড়শি মুসলিম মানুষের জেলা ও শহরগুলো থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নিয়ে। বস্তুত ১৯৪৭ সালের পর কলকাতা শহরের জনবিন্যাস যে পুরো বদলে গেছে সেটা আমরা স্বীকার করি না। ভারতের অন্যান্য শহরের সঙ্গে কলকাতার পার্থক্য এই যে এখানে বাঙালি মুসলমানদের অস্তিত্ব নেহাত দুরবিন দিয়ে দেখতে হয়।


আমাদের দেশভাগের আলোচনায় তারা প্রায় নেই-ই। সাতচল্লিশ সালের পরে পূর্ব বাংলা থেকে যে হিন্দু উদ্বাস্তু স্রোত নেমেছিল তা এপারের সাহিত্য সংস্কৃতিতে মোটের ওপর ভালো গুরুত্ব পেয়েছে। নাটকে, সিনেমায় ওপারের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাধ্য হয়ে চলে আসা হিন্দু শরণার্থীদের কান্না আজও আমাদের চোখে জল আনে। কলকাতার আশপাশে বিপুল কলোনিগুলো আজও মানুষের জীবন সংগ্রামের সাক্ষী।

http://slogaaninc.blogspot.com


দেশভাগ গরিব বাঙালি মুসলমানদের গ্রামে ঠেলে দিয়েছে। ধনী, এলিট বাঙালি মুসলমানদের বড় অংশ ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যেই বাধ্য বা স্বেচ্ছায় তত্কালীন পূর্ব বাংলায় চলে গিয়েছিলেন।


স্বাভাবিকভাবেই তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থান আজ যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। এটা নিশ্চিত যে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম বাঙালি মুসলমানদের আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিয়েছে। তাহলে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে না গিয়েও এটা সাদা চোখেই দেখা যায় যে উদ্বাস্তু হিন্দু ও মুসলিম দুই পক্ষের অধিকাংশই আজ মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। বাকি থেকে গেল অবাঙালি—মূলত বিহারি মুসলমানরা।


উপমহাদেশে ১৯৪৭ যদি ক্লাইম্যাক্স বা চূড়ান্ত পরিণতি হয়, তবে নিশ্চিত তার পেছনে কলকাতা, নোয়াখালী ও বিহারের ভয়াবহ দাঙ্গার ভূমিকা বিরাট। সাধারণভাবে ভারতে দেশভাগের একমাত্র খলনায়ক বলে চিহ্নিত করা হয় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে। কিন্তু হালে নতুন নতুন অনেক গবেষণায় পরিষ্কার হচ্ছে, জিন্নাহ দোষী কিছুটা নিশ্চিত, কিন্তু অন্য কুশীলবরাও কেউ নিরীহ, নির্দোষ নন। সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ধনী শিল্পপতি বিড়লা—অনেকেই নিজ নিজ স্বার্থে দেশভাগ চেয়েছিলেন। বরং জিন্নাহর মধ্যে কিছুটা হলেও দোদুল্যমানতা ছিল।


গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বা নোয়াখালী ম্যাসাকারের পরও জিন্নাহ পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না দেশভাগ নিয়ে। কিন্তু বিহারের ঘটনার পরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সব আশা ছেড়ে দিতে অনেকটা যেন বাধ্য হন।


পরে অনেকবার, অনেক জায়গায় সখেদে জিন্নাহ বলেছেন, বিহারের হত্যাকাণ্ডই ভারত ভাগকে চূড়ান্ত করে দিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কলকাতা ও নোয়াখালীর বীভৎসতা মনে রেখেও বলব, অবিভক্ত ভারতের দাঙ্গার ইতিহাসে বিহারের মতো ব্যাপক ও হিংস্র গণহত্যা বিরল।


অথচ সেই বিহার নিয়ে চর্চা নিতান্তই কম। দেশভাগের ওপর এক ডকুমেন্টারি সিরিজ করতে গিয়ে আমি বিহার নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ি। নোয়াখালী আমি গেছি। গান্ধীজি যেখানে যেখানে গেছিলেন, সেই গ্রামের বেশ কয়েকটায় গিয়ে এখনো যে দু-চারজন বেঁচে আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি ঠিক কী কী কারণে অত মারাত্মক ঘটনা ঘটল। কলকাতা তো আমার নিজের শহর। ফলে খোঁজ খবর নেয়া সহজ।


কিন্তু বিহার নিয়ে সেভাবে জানতাম না। এখন যেটুকু জানি, তাতে খুব স্পষ্ট করে বলে দিই, একটা মিথ আছে, নোয়াখালীর বদলা নিতেই বিহারের দাঙ্গা। অর্থাৎ নোয়াখালী না হলে বিহার শান্ত থাকত। ভাবটা হচ্ছে তুমি আগে ঢিল মেরেছ, ফলে পাটকেল তো তোমাকে খেতেই হবে। পারস্পরিক দোষারোপ না করে ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বলা যায়, কোনো না কোনো কারণে বিহার ঘটতই। ফলে যা বলছিলাম যে ওই মিথ, যা ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সযত্নে নির্মিত—বিহার নোয়াখালীর প্রতিক্রিয়া, তা আদৌ ঠিক নয়। সর্বৈব মিথ্যে ধারণাটি বছরের পর বছর আমরা বিশ্বাস করে আসছি।


নোয়াখালী হত্যা ঘটে ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে। আর কলকাতার দাঙ্গা ’৪৬-এর ১৬ আগস্ট। তার অনেক আগে ১৯৪৬-এর এপ্রিলে শ্রীকৃষ্ণ শাহ বিহারের কংগ্রেস সরকারের প্রধান হিসেবে রাজ্যের কুরসিতে বসেন। তার দুই মাস বাদেই জুন থেকে সারা বিহারে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়।


তারপর কলকাতা। তার প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালী। মনে রাখতে হবে তখন বিহার অগ্নিগর্ভ হয়েই ছিল। বলা যেতে পারে যে আগুনে ঘি পড়ে নোয়াখালীর বীভৎসতায়। কংগ্রেস ২৫-২৬ অক্টোবর বিহারজুড়ে নোয়াখালী প্রতিবাদ দিবসের ডাক দেয়। রাজ্য সরকার তা সমর্থন করে। কলকাতায় ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের ডাকা ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে তে সরকার ছুটি দেয়ায় দাঙ্গা ভয়ংকর চেহারা নেয় বলে আজও সরকারপ্রধান সোহরাওয়ার্দী নানা মহলে বিপুল ঘৃণিত। অথচ দুদিনের প্রতিবাদ দিবসে শ্রীকৃষ্ণ শাহ ও তার মন্ত্রিসভার সরাসরি সমর্থন কিন্তু কখনো কোথাও কোনো নিন্দার মুখে পড়েনি। বরং বিহার জেনোসাইড নিয়ে সরকারের ভূমিকা আড়াল করে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন। এ ধরনের অর্ধসত্য ইতিহাস আজও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির পক্ষে বড় বাধা।


নোয়াখালী বা কলকাতা দুই জায়গায়ই ধিকিধিকি করে জ্বললেও মোটের ওপর দাঙ্গার আগুন নিভে গিয়েছিল কয়েক দিনের মধ্যে। বিহারে তা শুরু হয়েছিল ২৫ অক্টোবর। টানা চলেছিল ১০ নভেম্বর পর্যন্ত। এ দীর্ঘ সময় মিলিটারি ডাকা হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বিস্তারিত খবর জানতেই পারেন অনেক দেরিতে। তিনি বিহারে ছুটে যান ৫ নভেম্বর। তার পর পরই মিলিটারি নামে। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেনা না নামানোয় সোহরাওয়ার্দী আজও সমালোচিত, আর প্রায় এক মাস ধরে গণহত্যা চলছে দেখেও বিহার সরকার কেন নিশ্চুপ ছিল তা নিয়ে আজও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কেউ প্রশ্ন তোলেন না। সে সময় কেন্দ্রীয় হোম মিনিস্টার ছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল। তার ভূমিকাও বা কী ছিল তা স্পষ্ট নয়।


তবে নেহরু কিন্তু সত্যিই মর্মাহত হয়েছিলেন। নিজের সহকর্মীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্যে তো বটেই, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দেখেও।


আক্ষরিক অর্থেই বিহার তখন জ্বলছে। পাটনা, মুঙ্গের, ছাপরা, ভাগলপুর, বিহার শরীফ সর্বত্রই দাঙ্গার লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে অতীতের পাটালিপুত্র। নেহরু মিলিটারি নামিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করলেন। ততদিনে সব হাতের বাইরে চলে গেছে। বেশ কয়েক হাজার মানুষ—নারী, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে নিহত হয়েছেন। কয়েক লাখ বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় খুঁজে চলেছেন। মুসলিম লীগের নেতৃত্ব এখানে সেখানে কিছু শিবির করে আতঙ্কিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করছেন। সব বাংলার লাগোয়া এলাকায়। নেহরু সঠিক বুঝেছিলেন, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে মানুষের মনে। দুটো সম্প্রদায়ের কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এমন এক অবস্থা, যেখানে লীগের শিবিরে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের ঢোকার অনুমতি নেই।


আর হিন্দু পরিবারের বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে লেখা বিঅ্যাওয়ার অব মুসলিম বা মুসলমানদের থেকে দূরে থাকো। নেহরু সখেদে বলে উঠেছিলেন, পরস্পরের প্রতি এত ঘেন্না নিয়ে কীভাবে আগামী দিনে ভারত এক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে! এমন বিদ্বেষ নিয়ে কোন দেশ আমরা গড়ে তুলব!!


ততদিনে দেশভাগ চূড়ান্ত হয়ে গেছে। জিন্নাহ স্বয়ং পাকিস্তান দাবি কত যুক্তিযুক্ত তা বোঝাতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিহার দাঙ্গা নিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজের রিপোর্ট পেশ করেছেন। যে বাংলাদেশ নিয়ে এক সময় বিহারে লোকগাথা ছিল, ওখানে গেলে মেয়েরা মরদদের মাছি বানিয়ে দেবে, সেখানেই বাস্তুচ্যুত মুসলমানদের আসতে হলো। পাকিস্তান হওয়ার পর বাঙলার অংশ হয়ে তারা ছুটে গেল পূর্ব বাংলায়। ১৯৪৭ সালের আগেই মুসলিম লীগের আপত্কালীন রিফিউজি ক্যাম্প বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন শুধু ভাগ-বাঁটোয়ার হিসাবনিকাশে হিন্দু ও মুসলিম নেতারা ব্যস্ত। একদিন যারা রাস্তায় নেমে ‘কানমে বিড়ি মুমে পান লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান তুলে হাতে অস্ত্র নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল তাদের কথা তখন আর কেউ মনেও রাখেনি। খাজা নাজিমউদ্দিন সাফ জানিয়ে দিলেন বিহার-ইউপির মুসলমানদের দায় পূর্ব বাংলা নেবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারাও তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। 

১৯৪৭-৫০ সাল পর্যন্ত তবু অবাঙালি মুসলমানরা দলে দলে পূর্ব বাংলায় গেছে। যেতে বাধ্য হয়েছে। কখনো খাতির পেয়েছেন নতুন দেশে গড়ে উঠতে থাকা শিল্পে সস্তা শ্রমিক হিসেবে। কখনো নবজাগ্রত বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের শাসকদের হাতের তাস হিসেবে। কিছু ভর্তুকি দিয়ে পাকিস্তানের শাসকরা ইচ্ছে করে বাঙালি-অবাঙালি সম্পর্কে ফাটল ধরাতে চেয়েছেন প্রথম থেকেই। তার পরিণতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অবাঙালি মুসলমানদের বিরাট অংশের রাজাকার, আলবদর হয়ে মুক্তিসংগ্রামের বিরোধিতা করা।


আমি দু-একবার ঢাকা, খুলনার বিহারি ক্যাম্পে গেছি। ক্যাম্প না বলে দান্তের নরক বলাই ভালো। অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মধ্যে কোনো রকমে টিকে থাকা। ইদানীং যতটুকু শুনেছি তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হচ্ছে। স্বাধীনতার এত বছর তারা পাকিস্তান, ভারত কিংবা নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশের নাগরিক অধিকারটুকুও পায়নি। ফলে কোনো সন্দেহ নেই দেশভাগের সবচেয়ে বড় ভিকটিম ওই বিহারি লোকজন। যাদের কথা কেউই মনে রাখেনি। আজও তাদের সম্বল শুধুই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী বলে তীব্র ঘৃণা। অথচ ইতিহাস জানে সবাই কিন্তু রাজাকার ছিল না। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। কেউ কেউ ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। অনেকেই জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার বিরোধিতাও করেছিলেন।


একবার দুপুরে খুলনার এক বিহারি বস্তিতে ঘুরছি। এক বৃদ্ধ জানতে চাইলেন, আমি কখনো সিওয়ান গেছি কিনা! জায়গাটা বিহার, উত্তর প্রদেশের সীমান্ত লাগোয়া। আমি গেছি শুনে বুড়ো মানুষটি আমার হাত দুটো জড়িয়ে বিড়বিড় করে শুধু বলতে লাগলেন, হামারা মুলুক। সেই কবে দাঙ্গায় সব খুইয়ে ভাসতে ভাসতে খুলনার ক্যাম্পে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। সেই তার বুকের মধ্যেও থেকে গেছে হারিয়ে যাওয়া এক টুকরো স্বদেশ।



সৌমিত্র দস্তিদার: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.

Post Top Ad

{SCOpenGraph image=http://site.com/link-to-homepage-image.jpg}