সম্পর্কের বিবর্তনে আধিপত্যের বিষ
মানুষের জীবন বহুবিধ সম্পর্কের এক জটিল জাল। শৈশবে পরিবার নামক আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা, এরপর পারিপার্শ্বিক জগৎ ও আপনজনদের প্রভাব আত্মস্থ করা—এভাবেই একজন ব্যক্তি ধীরে ধীরে স্বতন্ত্র সত্তা লাভ করে। শিক্ষক, বন্ধু এবং নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাকে আরও বিকশিত করে তোলে। এই অর্জিত গুণাবলী দিয়েই সে সামাজিক, ধর্মীয় ও হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক স্থাপন করে। তবে সময়ের সাথে সাথে এসব সম্পর্কে জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেখানে আধিপত্যের মতো নেতিবাচক মানসিকতা তিক্ততা সৃষ্টি করে।
মনোচিকিৎসকের ভাষ্যে আধিপত্য
সম্পর্কের এই জটিল দিকটি নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামালের মূল্যবান মতামত পাওয়া যায়। তিনি আধিপত্যকে একটি 'ডমিনেটিং ক্যারেক্টার' বা কর্তৃত্ববাদী বৈশিষ্ট্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এ ধরনের ব্যক্তিত্ব নিজের স্বার্থ ও মতকেই প্রাধান্য দেয়। তারা আত্মম্ভরী, অহঙ্কারী এবং নিজেদের সিদ্ধান্তকেই অভ্রান্ত মনে করে। নিজেদের ভুল তারা সহজে স্বীকার করতে চায় না।
ডা. কামাল সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—মানিয়ে নেওয়া (অ্যাডজাস্টমেন্ট), অভিযোজন (অ্যাডাপটেশন) এবং acceptance (গ্রহণ)-এর ওপর জোর দেন। তার মতে, আধিপত্যবাদী চরিত্রে এই গুণগুলোর অভাব দেখা যায়। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, আধিপত্য সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা সৃষ্টি করে, তা স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা বা সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই হোক না কেন। কোনো সম্পর্কে একজনের কর্তৃত্ব ফলানোর প্রবণতা অন্য ব্যক্তিকে গভীরভাবে আহত করে।
সমস্যা সমাধানে আলোচনার গুরুত্ব তুলে ধরে ডা. কামাল বলেন, যেকোনো সম্পর্কের জটিলতা নিরসনে খোলামেলা আলোচনা অপরিহার্য। অন্যের দোষ না খুঁজে তাদের ইতিবাচক দিকগুলো বিবেচনা করলে আধিপত্যের tendency অনেকাংশে কমে আসে। প্রতিটি বিষয়ে একটি গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা জরুরি। ডা. মোহিত কামালের বিশ্বাস, গণতান্ত্রিক মতামতকে গুরুত্ব দিলে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে জটিলতা হ্রাস পাবে।
কর্তৃত্ববাদিতা প্রতিরোধের উপায়:
শিশুদের মধ্যে যাতে আধিপত্যের বীজ প্রোথিত না হয়, সে জন্য ডা. মোহিত কামাল কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, শিশুরা যখন বুঝতে শিখতে শুরু করে তখন থেকেই তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ, সন্তানের জন্য শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের কথা জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। এই ধরনের অংশগ্রহণের সুযোগ তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি করে এবং স্বতন্ত্র পরিচিতি গড়ে তোলে। তারা অন্যের মতামতকে সম্মান করতে শেখে, যা পারিবারিক পরিবেশ থেকেই অর্জিত হয়।
এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, কাউকে ছোট করে দেখা বা অবিশ্বাস করার প্রবণতা থেকেই সম্পর্কে আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। অভিভাবকদের কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ (ডমিনেটিং প্যারেন্টিং) সন্তানদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের জন্ম দিতে পারে। "আমি যা বলছি সেটাই চূড়ান্ত, তোমাকে মানতে হবে," অথবা "আমি কি তোমার চেয়ে কম বুঝি?"—এই ধরনের কথা একজন ব্যক্তিকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে।
ডা. মোহিত কামালের মতে, সন্তান যখন বড় হচ্ছে, তখন তার যোগ্যতা, দুর্বলতা এবং ভুলগুলো সম্পর্কে তাকে অবগত করা উচিত। এর মাধ্যমে সে নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার এবং যোগ্যতা বিকাশের চেষ্টা করবে। নিজের পরিচয় নিজে তৈরি করতে শিখবে, যা পরবর্তী জীবনে চলার পথে পাথেয় হবে।
পরিশেষে ডা. কামাল স্মরণ করিয়ে দেন যে, আধিপত্যবাদী মনোভাব নিয়ে চললে বন্ধু পাওয়া যায় না এবং ভালো বন্ধু হওয়াও সম্ভব নয়। এই সমস্যা দাম্পত্য জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তিরা অন্যদের দমিয়ে রাখতেই পছন্দ করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন