লিভার আমাদের শরীরের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঙ্গ, যা ডানদিকের পেটের উপরের অংশে অবস্থিত। এটি একটি জটিল অঙ্গ যা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, যার মধ্যে রয়েছে:
- খাদ্য হজম: লিভার পিত্তরস তৈরি করে, যা চর্বি ভেঙে ফেলে এবং খাদ্য থেকে পুষ্টি শোষণে সাহায্য করে।
- বিষাক্ত পদার্থ অপসারণ: লিভার রক্ত থেকে বিষাক্ত পদার্থ এবং ওষুধের বিপাকগত পণ্যগুলি সরিয়ে ফেলে।
- রক্ত নিয়ন্ত্রণ: লিভার রক্ত জমাট বাঁধার কারণগুলি তৈরি করে এবং রক্ত ক্ষয় রোধ করে।
- শর্করা সংরক্ষণ: লিভার অতিরিক্ত গ্লুকোজ (শর্করা) গ্লাইকোজেন হিসাবে সংরক্ষণ করে এবং প্রয়োজনে রক্তে প্রকাশ করে।
- প্রোটিন তৈরি: লিভার অ্যালবুমিন এবং অন্যান্য প্রোটিন তৈরি করে যা রক্তে পরিবহিত হয়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: লিভার কিছু রোগ প্রতিরোধকারী কোষ তৈরি করে।
লিভারের ক্ষতি কিভাবে হয়?
লিভার বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:
- অতিরিক্ত মদ্যপান: অ্যালকোহল লিভারের কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং সিরোসিস সহ গুরুতর লিভার রোগের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
- হেপাটাইটিস: হেপাটাইটিস এ, বি এবং সি ভাইরাস লিভারের প্রদাহ এবং ক্ষতির কারণ হতে পারে।
- চর্বিযুক্ত লিভার রোগ: অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা লিভারে চর্বি জমা হতে পারে, যা লিভারের ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
- ওষুধ: কিছু ওষুধ, যেমন অ্যাসিটামিনোফেন এবং কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, লিভারের ক্ষতি করতে পারে।
- স্বাস্থ্যগত অবস্থা: কিছু স্বাস্থ্যগত অবস্থা, যেমন অটোইমিউন রোগ এবং কিছু জিনগত ব্যাধি, লিভারের ক্ষতি করতে পারে।
লিভারের ক্ষতির লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- পেটের উপরের ডানদিকে ব্যথা
- খাবারের প্রতি অনীহা
- ক্লান্তি
- বমি বমি ভাব এবং বমি
- ত্বক এবং চোখের হলুদ ভাব (জন্ডিস)
- গাঢ় প্রস্রাব
- পায়ে ফোলাভাব
সুস্থভাবে বাঁচতে ও স্বাভাবিক কার্যক্রমে আমাদের শরীরে যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অবদান রাখে, তার মধ্যে লিভার অতিগুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ থাকতে লিভারের খেয়াল রাখতেই হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লিভার খারাপ হওয়ার কারণ হয় কিছু বদভ্যাস।
জেনে নিন লিভার সুস্থ রাখার ১০টা সহজ নিয়ম
ফ্যাটি লিভারের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। একই সঙ্গে লো ফ্যাট ফুড থেকেও সাবধান থাকতে হবে। কারণ, এসব খাবার থেকে ফ্যাট বাদ দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু খাবারের স্বাদ ধরে রাখতে প্রচুর পরিমাণ চিনি যোগ করা হয়। এতে লিভারের সমস্যা আরও বেড়ে যায়।
স্ট্রেস থাকলে খাবেন না– বোর হলে, এনার্জি কম লাগলে কী করি আমরা? অনেকেই এই সময় খাবার খেয়ে মুড ঠিক করতে চান। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, লিভার সুস্থ রাখতে স্ট্রেসের সময় খাবার ছোঁবেন না। এ সময় হজম ঠিকমতো হয় না।
রসুন আমাদের লিভার থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। ফলে লিভারে ক্ষতিকারক চর্বি জমা হয় না। রসুনে অনেক প্রাকৃতিক যৌগ থাকায় এটি শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কাজকেও বাড়িয়ে তোলে।
সাপ্লিমেন্ট– প্রোটিন বা ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার সময় সতর্ক থাকুন। এমন সাপ্লিমেন্ট বাছুন, যা লিভার ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে। ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স, ভিটামিন ‘সি’ লিভার পরিষ্কার রাখে। প্রোটিনের মধ্যে থাকা অ্যামাইনো এসিডও লিভার পরিষ্কার রাখার জন্য ভালো। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
ওষুধ থেকে সাবধান– বেশি কিছু ওষুধ লিভারের ক্ষতি করে। এসব ওষুধ থেকে দূরে থাকুন। কিছু পেনকিলার, যেমন টাইলেনল বা কোলেস্টেরলের ওষুধ লিভারের প্রভূত ক্ষতি করে।
কফি– কফি খাওয়ার কিন্তু অনেক সুফল রয়েছে। গবেষণা জানাচ্ছে, নিয়মিত কফি খেলে লিভারের অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্তত ১৪ শতাংশ কমে যায়।
টক্সিন– ত্বকে বিষক্রিয়া লিভারের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। ত্বকের মাধ্যমে বিষ রক্তে শোষিত হয়। তাই স্প্রে, টক্সিন থেকে দূরে থাকুন।
প্লান্ট প্রোটিন– লিভার সুস্থ রাখতে সবচেয়ে বেশি জরুরি সঠিক খাবার বাছা। অ্যানিম্যাল প্রোটিন থেকে লিভারের জন্য বেশি ভালো প্লান্ট প্রোটিন। ডাল, সবুজ শাকসবজি, বাদাম, ফাইবার খান।
হেলদি ফ্যাট– ফ্যাট শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তাই লিভার সুস্থ রাখতে ফ্যাট ডায়েট থেকে একেবারে বাদ দিয়ে দেবেন না। হেলদি ফ্যাট খান। অলিভ, ওয়ালনাট জাতীয় খাবারে হেলদি ফ্যাট থাকে।
লেবু ফ্যাটি লিভারের কারণে হওয়ার লিভারের ক্ষতি সারাতে সাহায্য করে। এতে থাকা উচ্চমাত্রায় ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীর থেকে সব বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। ফলে কোষগুলোকে রক্ষা করে এবং লিভারের ক্ষতি হতে দেয় না।
লিভারের সবচেয়ে কমন সমস্যাটি হলো হেপাটাইটিস। লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হলে রোগী জন্ডিস ও এর উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসেন। কারণ হেপাটাইটিস এ এবং ই হয় দূষিত খাবার ও পানি গ্রহণের মাধ্যমে। হেপাটাইটিস বি হয় রক্ত পরিসঞ্চালন, একই সুঁই , সিরিঞ্জ, কাঁচি ব্যবহার করার কারণে।
আমরা প্রায়ই শুনে থাকি 'ফ্যাটি লিভার।' এটাকে কোনও ভাবেই অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসা করা না হলে হেপাটাইটিস এমনকি লিভার ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। তাই জন্ডিসের উপসর্গ দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে বা কোনও প্রকার ঝাড়-ফুঁক না করিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন